পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সব থেকে বড় জনগোষ্ঠী
আমাদের কথাঃ
আপনার জাতি পরিচয় কি? চাষি-কৈবর্ত? না কি মাহিষ্য? হোক বিতর্ক, আপনি বলুন।
তথ্য – ১: Census Report – 1872( A Statistical Account of Bengal) by W.W. Hanter, Vol-(iii) part-(ii), page no- 38. রিপোর্টে কোথাও মাহিষ্য জাতির উল্লেখ নাই কিন্তু কৃষিজীবি হিসাবে কৈবর্ত এবং মৎস্য জীবি হিসাবে জেলিয়া উল্লেখ আছে। তাহলে কি তৎকালীন সময়ে ‘মাহিষ্য’ বলে কোন জাতি ছিল? ছিল না। যদি থাকত তাহলে ১৮৭২ সলের জনগণনার রিপোর্টে অবশ্যই উল্লেখ থাকত।
তথ্য -২: Sundarbon Gazetteers by W.W. Hunter, Vol-(i) part- (ii) page – 35, The Population – এখানে উল্লেখ আছে যে সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাসকারি জাতি গুলির মধ্যে কৈবর্তরা মূলত চাষবাস ও মৎস্য স্বীকার করার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। মাহিষ্য জাতির কোনো উল্লেখ নাই। তাহলে আমরা মাহিষ্য জাতি হলাম কি করে ? আমরাতো বংশ পরম্পরায় এই অঞ্চলের বাসিন্দা।
তথ্য -৩: Report of the Age of Consent Committee 1928-29 by Govt. of India 1929, Chapter –IV, page no-65 – “ In Bengal the Chasi-Kaibartta class is the largest Caste among the Hindus. Its population being over 2 milions. The member belong to the depressed classes.”
তথ্য -৪: ভগিনী নিবেদিতার লেখা “স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি”, প্রকাশক- রামকৃষ্ঞ মিশন উদ্বোধন কার্যালয়। বইটির বিংশ পরিচ্ছদে উল্লেখ পাই – “ দক্ষিণেশ্বর মন্দির জাতিতে কৈবর্ত ধনাঢ্য রানী রাসমণি কর্তৃক নির্মিত হয়,” অথচ বর্তমানে একদল লেখক ও কয়েকটি সমাজ যেমন –মাহিষ্য সমাজ দাবি করেন রানী রাসমণি মাহিষ্য ছিলেন। ২২৩ বৎসর পূর্বে যখন রানী রাসমণির জন্ম হয়, তখন পশ্চিমবঙ্গে মাহিষ্য বলে কোনো জাতি ছিলনা। তিনি ছিলেন শুধুই কৈবর্ত, না জেলে কৈবর্ত, না চাষি-কৈবর্ত, না মাহিষ্য।
তথ্য -৫: Bengal District Gazetters Midnapore by L.S.S. O’Malley published by Govt.of West Bengal 1995, page no-70 –“The name Mahishya is a new one adopted since the Census of 1901”.
“ Neary all are cultivating Kaibarttas or Mahishya and only a small minority are fishing Kaibarttas or Jeliyas, who occupy a very low position in the social scale.”
তাহলে ভেবে দেখুন রানি রাসমণী কৈবর্ত না মাহিষ্য।
তথ্য -৬. বীরেন্দ্রনাথ শাসমলকে কেওটা ( Being a Kayot of Midnapore……..-Statesman : 1991) নীচু জাত বলে কংগ্রেস তাকে বঞ্চিত করে কায়স্থ সুভাষ চন্দ্র বোসকে কোলকাতা কর্পোরেশনের চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের পদ দেওয়া হয়। তাহলে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল কৈবর্ত না মাহিষ্য?
তথ্য -৭. মন্ডল কমিশন পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রহসর শ্রেণীর যে তালিকা প্রস্তুত করেন সেখানে মাহিষ্য ও.বি.সি. তালিকা ভুক্ত জনগোষ্ঠী (ক্রমিক সংখ্যা-১৩১), চাষী-কৈবর্তরাও ঐ তালিকায় ছিল এবং বর্তমানে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত ওবিসি সংরক্ষণের তালিকা ভুক্ত জনগোষ্ঠী। তাহলে মাহিষ্য নামকে সংরক্ষণ থেকে বাদ দিল কে?
তথ্য -৮. ভারত সরকার প্রকাশিত আম্বেদকর রচনা সম্ভার প্রথম খন্ড পৃষ্ঠা- ২২৮, পরিশিষ্ট -৯ উল্লেখ আছে –চাষি, কৈবর্ত (মাহিষ্য) : ২৩,৮১,২২৬ জন ; বাংলা।
মাহিষ্য যদি আলাদা জনজাতি বা জনগোষ্ঠী হয় তাহলে চাষি,কৈবর্তদের সঙ্গে বন্ধনীতে উল্লেখ কেন? তাহলে কি উচ্চবর্ণের লোকেরা কৈবর্তদের ‘মাহিষ্য’ বলে সম্মান দিত, না কি গালি দিত, না কি ডাক নাম বা নেকনেম হিসাবে ব্যবহার করত? অন্তত এটা বলাই যায় যে মাহিষ্য কোনো আলাদা জাত নয়।
তথ্য -৯. সংসদ কিশোর বাংলা অভিধান (সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত) পৃষ্ঠা- ৬৮০ : মাহিষ্য শব্দের অর্থ – (মা-হি-শো) বি. এক সময় পশুপালক ছিল এমন হিন্দু জাতি বিশেষ (মহিষ+য)। অন্যান্য প্রায় সমস্ত অভিধানে কম বেশী একই ব্যাখ্যা পাই। উপরিউক্ত অর্থটি কি খুব সম্মানীয়? যদি অভিধানের অর্থ ভুল হয় তাহলে মাহিষ্য সমাজপতিরা এর প্রতিবাদ করেনি কেন?
তথ্য -১০. West Bengal Commission for Backward Classes seventh Report – point 24 – “ The opinion that the Chasi-Kaibartta class constitutes a backward class in the state, though the class Mahishya born and grown out of Chasi-Kaibartta class may have considerably advance……”
তাহলে কি ইচ্ছাকরলেই জাত বা কূল বা বংশ পরিবর্তন সম্ভব? যদি একবার সম্ভব হয়, তাহলে পুনরায় তা সম্ভব নয় কেন?
তথ্য -১১. A letter issued by deputy Secretary of West Bengal Commission for Backward Classes, No- 269-RI- 6/94 dated – 2/11/1995 to Secretary, Mahishya Kalyan Samity – for hearing inclution of the class – “ Hele / Helia / Chasi-Kaibartta ( mahishya)”.
মন্ডল কমিশন পশ্চিমবঙ্গের জন্য যে ওবিসি তালিকা প্রস্তুত করেন তার ১৩১ নং নাম ছিল ‘মাহিষ্য’ এবং ৪২নং নাম ছিল চাষি-কৈবর্ত । তাহলে কমিশন কেন মাহিষ্য কল্যান সমিতিকে শুধু ‘মাহিষ্য’ শুনানীর জন্য ডাকলেন না ? তাহলে কি কমিশন জানত যে চাষি-কৈবর্ত আসল জাতি হলেও ‘মাহিষ্য’ কোনো জাতি নয়, কেবল মাত্র কেউ কেউ তাদের মাহিষ্য বলে অভিহিত করে ? আর এই জন্যই কি কমিশন ‘মাহিষ্য’ শব্দটি বন্ধনীর মধ্যে ব্যবহার করেছেন ? যদি তা না হয় তাহলে – Hele /Helia /Chasi-Kaibartta” –দের সঙ্গে কেন তার ব্যাখ্যা দিক কমিশন।
তথ্য -১২. বাঙ্গালীর ইতিহাস – আদিপর্ব, প্রথম খন্ড : ড: নিহার রঞ্জন রায়ের লেখা ( বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ) থেকে পাওয়া যায় – পাল আমলে কৈবর্তদের উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু মাহিষ্যদের কোনো উল্লেখ নেই।দ্বাদশ শতকের গোড়ায় ভবদেব ভট্ট বা কবি সন্ধাকর নন্দী কৈবর্তরা যে মাহিষ্য এরকম কোনো উল্লেখ করেন নাই।
দ্বাদশ শতকের গোড়ায় ভবদেব ভট্ট কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অন্তজ পর্যায়ে। ব্রম্ভবৈবর্ত পুরানে ধীবর ও কৈবর্তদের স্থান নির্দেশ করিতেছেন অসৎশূদ্র পর্যায়।
বর্তমান কালে পূর্ববঙ্গের হালিক দাস এবং পরাশর দাস এবং হুগলী, বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের চাষী-কৈবর্তরা নিজেদের ‘মাহিষ্য’ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। পূর্ববঙ্গের ধীবর ও জালিকরা কৈবর্ত বলিয়া পরিচিত।
কৈবর্ত ও মাহিষ্যরা এক ও অভিন্ন বলিয়া সমাজে প্রচলিত ও স্বীকৃত হয়।
উপরের তথ্য গুলি থেকে পরিষ্কার যে পশ্চিমবঙ্গে মাহিষ্য বলে কোনো জাত বা জনগোষ্ঠী ছিলনা। আসলে একদল বর্ণহিন্দু , এই সমাজের মানুষকে ভুল বুঝিয়ে সমগ্র সমাজকে ভুল পথে চালনা করেছে। অশ্বডিম্ব প্রসবের ন্যায় প্রলভোনের ফাঁদে জড়িয়ে অতীতের ঐতিহ্যপূর্ণ কৈবর্ত জাতি (পশ্চিমবঙ্গের সর্ব বৃহৎ জাতি, ৩.৫ কোটি) অবহেলিত, নির্যতিত, নিপিড়ীত জাতিতে পরিনত হয়েছে। এই সমাজের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার সুকৌশলে হরন করে তা ভোগ করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের (ছয় শতাংশ ব্রাম্ভণ, কায়স্থ্য, বৈদ্য) মানুষ। পূর্বপুরুষের অজ্ঞতা এবং বর্ণহিন্দুদের চাতুর্যের কাছে পরাজিত হয়ে পশ্চিমবাংলার সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী চাষী-কৈবর্ত (মাহিষ্য) আজ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সর্বদিকদিয়ে পিছতে পিছতে সকলের শেষে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কতদিন চুপ করে বসে থাকবে ভেবে দাখুক – এই সমাজের গুটি কয়েক মানুষ যারা এখনো উচ্চপদে আসীন আছেন, যাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠীত, যারা উচ্চ শিক্ষিত। সকলের কাছে আমার আবেদন সকলে এগিয়ে আসুন বাংলার বৃহত্তম জনগোষ্ঠী (প্রায় ৩.৫ কোটি) চাষী-কৈবর্ত(মাহিষ্য) সমাজের উন্নয়নের রূপরেখা তৈরীতে।
আপনার পরিচয় কি? চাষী-কৈবর্ত ? না কি মাহিষ্য? হোক বিতর্ক , চলুক সমালোচনা কিন্তু তার মাঝে উন্নয়নের রূপরেখা তৈরীহোক চাষী-কৈবর্ত(মাহিষ্য) জাতির। এটাই আমার কামনা।
সিদ্ধানন্দ পুরকাইত,
সম্পাদক,
ডাঃ হাঃ চাষি-কৈবর্ত সমাজ।